কৃষক বাঁচাতে অবশেষে গুচ্ছ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আগামী বোরো মৌসুমের আগেই এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে। এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কৃষি খাতে সার্বিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কৃষিকে লাভজনক পেশায় উন্নীতকরণ এ সরকারের একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কৃষিকে লাভজনক করার লক্ষ্যে একে যান্ত্রিকীকরণ, আধুনিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ করার সব উদ্যোগই নেওয়া হয়েছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্যোগ ভালো। তবে তা বাস্তবায়নে সরকার ও জনগণকে একাট্টা হতে হবে। কৃষি বিশেষজ্ঞ রেজা সিদ্দীক বলেন, সরকার নানা উদ্যোগ নেয়, তবে তা মাঝপথেই থমকে যায়; থাকে না কার্যকর মনিটরিং। এটা জাতির দুর্ভাগ্য বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, কৃষক সমস্যায় পড়লেই কেবল আমরা সমাধানে আগ্রহী হই। এই উদ্যোগ আগে থেকে নেওয়া হলে এত বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় না সংশ্লিষ্টদের। বর্তমানে বোরো সংগ্রহের মৌসুম চলছে। এখন ধানের দাম এত কম যে, কৃষক উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না। ক্ষুব্ধ কৃষক মাঠেই পাকা ধানে আগুন দিচ্ছেন। মাঠের কৃষক দাবি আদায়ে হাতে তুলে নিচ্ছেন ব্যানার-ফেস্টুন; কিন্তু কেন এই দুর্ভোগ, তা নিয়ে সত্যিকারের তথ্য মিলছে না।
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, মজুদ সংকট কেটেছে। একই সময়ে কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, ধান কিনে রাখার জায়গা নেই। আর সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের এমন দড়ি টানাটানিতে নাকাল হচ্ছেন কৃষক। গতকাল মঙ্গলবার খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানিয়েছেন, চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ২৬ টাকা কেজি দরে আরও আড়াই লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
তিনি বলেন, ধানের উৎপাদন অনেক হয়েছে। ফলে মূল্য একটু কমেছে। কৃষকের এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য আরও ধান কেনা হবে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মিলারদের কাছে দেওয়া হবে চালে রূপান্তর করার জন্য। পাশাপাশি এ সমস্যা সমাধানের স্থায়ী পথ খোঁজা হচ্ছে। প্রান্তিক কৃষকের হাতে ধান নেই, আছে সচ্ছল কৃষকের গোলায়। এ অবস্থায় লাভের টাকা কার পকেটে যাবে সে উত্তর কেউ দিতে রাজি হননি।
তবে খাদ্যমন্ত্রী আমাদের সময়কে বলেছেন, ধান কেনার পরিমাণ নির্ধারণ করেছে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি (এফপিএমসি)। তখনই দেড় লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত হয়। প্রান্তিক কৃষকরা ধান সংগ্রহ শুরুর দেড় মাস পর কৃষকের কথা বলে আরও ধান কিনলে ভাগ্য আরও খুলবে সচ্ছল কৃষকের। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গা, রংপুরের কাউনিয়া, নীলফামারীর ডোমারের একাধিক প্রান্তিক কৃষক গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের সময়কে বলেন, এখন এত তোড়জোড় করলে আমাদের কী লাভ? আমাদের ধান তো মে মাসের শুরুতে কম দামে বেঁচে দিয়ে মহাজনের দাদনের টাকা শোধ করেছি।
কৃষক বাঁচাতে যত উদ্যোগ কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক আমাদের সময়কে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছেন কীভাবে ধানের দাম বাড়ানো যায়। তিনি দুটি পরামর্শ দিয়েছেন- আরও বেশি ধান কেনা এবং কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে মিলারদের মাধ্যমে চাল করা। কৃষিমন্ত্রী বলেন, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার ক্ষেত্রে আর্দ্রতা প্রধান সমস্যা। এ সমস্যা দূর করার জন্য ৩ হাজার পিস আর্দ্রতা পরিমাপ করার মিটার কেনার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
এসব মিটার ইউনিয়ন পর্যায়ে বিতরণ করা হবে, যাতে কৃষকরা তাদের ধানের আর্দ্রতা নিজ গ্রামেই পরিমাপ করতে পারেন। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে যান্ত্রিকীকরণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কৃষি প্রণোদনার ৩ হাজার কোটি টাকার কৃষি যন্ত্র কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী বোরো মৌসুমের আগেই কৃষিযন্ত্র ক্রয় সম্পন্ন হবে। বর্তমান পরিস্থিতে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা এবং চালের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করা হবে। ইতোমধ্যে ১০ থেকে ১৫ লাখ টন চাল রপ্তানির সিদ্বান্ত হয়েছে এবং রপ্তানিতে উৎসাহ দিতে প্রণোদনা ২০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধির চিন্তা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া চাষিদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন এবং ধানের ক্রয়মূল্য অগ্রিম নির্ধারণ করে মৌসুমের শুরুতেই সরাসরি কৃষক পর্যায় থেকে ধান সংগ্রহ শুরু করা হবে। ধান সংগ্রহের পরিমাণ পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করে ৫০ লাখ টনে উন্নীত করা হবে। এ ছাড়া সরকারের গুদামের ধারণক্ষমতা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করা হবে। চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে ২৮ শতাংশ থেকে ৫৫ শতাংশে। নন-ইউরিয়া সারসহ অন্যান্য উপকরণে প্রণোদনা বৃদ্ধি করা হবে। সেচের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিসহ ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে প্রণোদনা আরও বৃদ্ধি করা হবে। ধান মজুদে সাইলো নির্মাণ প্রান্তিক কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সারাদেশে ২০০ স্টিলের পেডি সাইলো (ধান সংরক্ষণের বিশেষ গুদাম) নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার আমাদের সময়কে এ তথ্য জানিয়ে বলেন, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনে এই সাইলোতে সংরক্ষণ করা হবে। প্রতিটি সাইলোতে ৫ হাজার টন করে ধান ২-৩ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। প্রতিটি সাইলো নির্মাণ করতে ৭ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এ সংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এটি অনুমোদনের জন্য শিগগির পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। বিশেষায়িত এসব সাইলো নির্মাণ করা হলে চালের পাশাপাশি আরও ১০ লাখ টন ধান সংরক্ষণ করতে পারবে সরকার। এ মুহূর্তে সরকারের ধান সংরক্ষণের জন্য বিষেশায়িত কোনো গুদাম নেই। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, আগামী ইরি-বোরো মৌসুমের আগেই আমরা ১০০টি সাইলো নির্মাণ করতে পারব বলে আশা রাখি।
জানা গেছে, ধান থেকে চাল বানাতে হাওর এলাকায় সরকারি খরচে ৫টি অটো রাইসমিল স্থাপন করা হবে। যাতে প্রয়োজনে পেডি সাইলো থেকে ধান নিয়ে দ্রুত চাল করা যায়। চালকল মালিকদের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতেই এ উদ্যোগ। চলতি বোরো মৌসুমে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর মধ্যে ১০ লাখ টন সেদ্ধ চাল, দেড় লাখ টন আতপ এবং বাকি দেড় লাখ টন ধান (এক লাখ টন চালের সমপরিমাণ) সংগ্রহ করছে। সংগ্রহ অভিযান ২৫ এপ্রিল শুরু হয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে। তবে তারিখ আরও বর্ধিত হতে পারে